সিদ কেটে চুরি বা সিঁধেল চুরি অথবা শিংকেটে চুরি বৃহত্তর দিনাজপুর অঞ্চলের একটা বিলুপ্তপ্রায় পেশা। সত্তর দশকের শেষ পর্যন্ত এই পেশার লোকদের দাপটে গ্রামগঞ্জের মানুষ আতংকে নির্ঘুম রাত কাটাতো। সে সময়ে সিঁধেল চোরদের দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে গ্রামগুলোতে পালাক্রমে পাহারায় থাকতো সাধারণ মানুষ। কালের পরিক্রমায় সিঁধেল চুরি বন্ধ হয়ে গেলেও আমার ছেলেবেলায় এদের আমি দেখেছি। সিঁধেল চোরদের কেউ কেউ রীতিমতো এলাকায় সেলিব্রেটিদের মতো পরিচিত ছিলেন। আমার শৈশবে তেমনি একজন সেলিব্রেটি চোর ছিলেন সাতঘড়ি চোর। তাঁর প্রকৃত নামটি হয়তো গ্রামের মানুষ ভূলেই গিয়েছিল। কিন্তু তিনি একরাতে ছয় সাতটা বাড়িতে সিদ কেটে চুরি করতো বলেই তাঁর নাম সাতঘড়ি হয়ে যায়। যখন বুঝতে সক্ষম হয়েছি যে, চোর ডাকাত কোন জীবজন্তু নয় তখন থেকে সাতঘড়ি ভদ্রলোককে দেখেছি। বেটে সাইজের ফর্সা সাতঘড়ি দিনের শেষ ভাতে আমাদের নতুন বাড়ীর সামনে দিয়ে হাটে যেতো। আবার সন্ধ্যার মধ্যেই বাড়ীতে ফিরে আসতো। সাতঘড়ি চোরের সুসন্তান সামশুল ও হাফিজুল বাপের পেশায় যুক্ত হয়েছিল। একটু বড় হওয়ার সাথে সাথে সামশুল ও হাফিজুলের সাথে কথা বলতাম ভয় নিয়ে। পরে দীর্ঘদিন হাফিজুল ও সামশুল আমাদের নতুন বাড়ীতে পাহারাদার হিসেবে কাজ করতো রাতে। গ্রামে চুরি বৃদ্ধি পেলে যেই চুরি করুক সামশুল আর হাফিজুল ধরে নিয়ে আসে বেদম মারপিট করতো। তাই অযথা মারপিটের হাত থেকে রক্ষা পেতে তাঁরা আমাদের বাড়িতে তখন বাধ্য হয়ে পাহারা দিতো। হঠাৎ একরাতে সামশুল আর হাফিজুল লাপাত্তা। পরে জানা যায় তারা ভারতের কোন এক নামকরা ডাকাতদলের সদস্য হয়ে বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতি করা শুরু করেছে।
সেসময়টা সীমান্ত এলাকার কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় দু-দেশের চোর ডাকাতদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের উন্নয়ন ঘটিয়ে তাঁরা বেশ দাপটের সাথে ডাকাতিতে যুক্ত হয়ে বেশ সুনাম অর্জন করে। ধীরে ধীরে সিঁধেল চোর সাতঘড়ির পরবর্তী প্রজন্ম সৃজনশীল সিদ কেটে চুরি করার কাজ ছেড়ে দেয়। এরপর কৃষিতে ব্যাপক আধুনিকায়নের সাথে সাথে গ্রামীণ কৃষি শ্রমিক তথা ক্ষেতমজুরদের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হওয়ায় সিঁধেল চুরির মতো সৃজনশীল এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে মানুষ দূরে সরে আসতে বাধ্য হয়। গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষার প্রসার,মাটির পরিবর্তে কংক্রিটের মেঝে এবং দেয়ালের কারণে সিঁধেল চুরি অসম্ভব হয়ে পরার কারণেও অনেকেই আর সিঁদকাটার মতো ঝুঁকি নেয়না। কিন্তু সেই অশিক্ষিত সাতঘড়িদের মতো বংশপরম্পরায় চৌর্যবৃত্তি কি আজও বন্ধ হয়েছে?এখনকার সাতঘড়িরা অনেক বেশি ভয়ংকর ও দূর্বৃত্ত। এরা দিনেদুপুরে নামে বেনামে ঋণের নামে ভূয়া কাগজ দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে বিদেশে সেকেন্ডহোম এবং বেগমপাড়া গড়ে তুলে।
শুরুতে যেই সাতঘড়ি চোরের সাথে সাথে তাঁর ছেলে সামশুল আর হাফিজুলের কথা বলেছিলাম। তাঁরা পরবর্তীতে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়। এবং সেখানে বেশ ভালোভাবে বসবাস করছে ঠিক আমাদের এযুগের সিঁধেল চোরা ছাগল মতিউর ও তাঁর সন্তান ইফাতরা একটু এগিয়ে কানাডা আর ইউএসএতে দাপটের সাথে আয়েশি জীবন যাপন করছে। চৌর্যবৃত্তি একটি সৃজনশীল কাজ সেটা সিঁধেল চুরি হোক অথবা সরকারি পদপদবী অপব্যবহার করে অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক বনে যাওয়া হোক। এই সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের সাথে শুধু সরকারি কর্মকর্তাগণ যুক্ত নয়। ঘরের পিছনে সিদ কেটে মানুষের সম্পদ লুন্ঠনের চেয়েও ভয়াবহ চুরি হলো রাজনীতিকে ব্যবহার করে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে জনপ্রতিনিধি হওয়া এবং জনপ্রতিনিধি পদকে ব্যবহার করে নিয়োগ বাণিজ্য, টিআর কাবিখা লুটপাট করে অল্প সময়ে বিত্তবৈভবের মালিক বনে যাওয়া। কাজেই অযথা চিৎকার না করে স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে আসা এই গণমানুষের রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এবং রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় প্রজাতন্ত্রের সেবকদের চৌর্যবৃত্তির বিরুদ্ধে গণমানুষের প্রতিরোধ গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই।